Monday, February 12, 2018

লাল জামাটা...



লাল জামাটার বয়স এখন পাঁচ মাস।জামাটার নিজেরও শখ ছিলো, কোনো এক বাচ্চা মেয়ের গায়ে নিজেকে জড়িয়ে ধন্য হবে। জামার স্টাইল আর কারুকার্য দেখে পাশের বাসার টুম্পার মাও শপিং এ যাবে। এরকম একটা জামা কেনার জন্য। সবার দৃষ্টি হবে লোভাতুর। জামাটা বসুন্ধরা থেকে কেনা, একদিন অপরাহ্ণে। লাবনী যেদিন আলট্রা করালো সেদিন ডাক্তার জানালো আপনি মেয়ে সন্তানের মা হতে চলছেন। লাবনী নিজেও চায়নি, এমনটা হবে। মেয়ে কেন! কোনো বাচ্চাই তো হওয়ার কথা ছিলনা। সব ধরনের প্রটেকশনই ছিলো, কিন্তু একি হলো? ততক্ষণে লাবনীর খেয়াল হয়েছে,যে এটা বেলুন দুর্ঘটনার ফল। মনটাই কেমন হয়ে গেল! তারপরেও ও মনে আশার বীজ বপন করে। এবার আর ওকে বিয়ের জন্য বায়না ধরতে হবেনা, রাসেলকে বুঝিয়ে বললেই ও বিয়ে করে নিবে। সুখের সংসার হবে। এরকম হাজারো স্বপ্ন লাবনীর মাথায় ঘুরতে থাকে।




ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরেই ডিপার্টমেন্ট এর বড় ভাই, রাসেল এর সাথে তার পরিচয় ঘটে। দেখতে কিছুটা খাটো হলেও ছেলেটা স্মার্ট, ক্রাশের পাত্র। একসাথে আড্ডা দেয়া থেকেই শুরু। ক্ষণে ক্ষণে আড্ডা দেয়ার সময়ে পরিবর্তন আসে। যেখানে সন্ধ্যার আকাশে আলো লীন হওয়ার আগেই ওদের দিনের লীলা শেষ হতো, তা এখন আর শেষ হতে চায়না। যেহেতু নয়টার পরেও কিছুটা সময় হাতে থাকে, তো এই সময়টা হলে না কাটিয়ে ও রাসেলের গা ঘেসে বসে কাটিয়ে দেয়। নানান স্বপ্ন মাথায় আসে। এরই মধ্যে ওরা একে অপরের নামের পরিবর্তন করে ফেলে। লাবনীকে দেখতে নাকি স্বর্গের অপ্সরীর মত লাগে, তাই রাসেল লাবনীকে অপ্সরী ডেকেই তৃপ্তি পায়। লাবনীও রাসেলকে হিরো ডাকে। খুনসুটি চলে পায়রা আর পায়রির মত। হাত সচল থাকতেও একজন অপরজনকে খাইয়ে দিতো, এযে স্বর্গীয় সুখ। লাবনী একদিন বলে, আচ্ছা আমরা কি এভাবেই কাটিয়ে দিব? রাসেল বললো কিছুটা দিন অপেক্ষা করো,চাকুরীটা হলেই তোমাকে বউ বানাবো। চলে নানান আহ্লাদি কথা, যার সীমানা শেষ হয়না। আজ লাবনীর মন ভালো নেই, কারন অজানা। প্রেম লাইফে এরকম নাকি যখন তখন, মন ভালো আবার খারাপ হয়ে যায়। মন ভালো করার সুযোগ নিয়ে রাসেল তাকে দূরে ঘুরে আসার অফার করে। লাবনী রাজি হয়ে যায়। বাসা থেকে অনুমতি না নিয়েই ওরা কক্সবাজারে চলে যায়। ইনানীর বিশাল ঢেউ লাবনীর হৃদয় ছুঁয়ে যায়। রাসেলকে বলেই ফেলে এখানে একটা বাড়ী বানাবা। হিমছড়ির চুড়ায় উঠে ওরা। যেখান থেকে সমুদ্রকে ভালোভাবে দেখা যায়।সামান্য হিমছড়িতে উঠেই লাবনী নিজেকে ওয়াসফিয়া নাজরিন ভাবতে শুরু করে। ওর কাছে সামান্য হিমছড়িও হিমালয়। পাশে হাতল থাকলেও অপ্সরী উঠেছে রাসেলের হাত ধরে। কক্সবাজারে এসে ওরা যখন লাবনী পয়েন্টে গেল, তখন রাসেল বললোঃ তোমার নামেই এই নামকরণ! সাগর পাড়েও সন্ধ্যা নামে, প্রকৃতির নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। সাগর পাড়ের অস্থায়ী সিটে ওরা সন্ধায় আধশোয়া হয়ে সাগরের গর্জন উপভোগ করে। মন চায় অনন্তকাল এখানে থাকতে, কিন্তু তা কি আর সম্ভব? ওরা বুকিং দেয়া হোটেলে চলে যায়। রাসেলের বহুল আকাঙ্ক্ষিত রুম ডেট চলে আসে। এর পরে বাকিটা দুর্ঘটনা! আজ আর রাসেল ফোন ধরেনা। এদিকে লাবনী সন্তান সম্ভাবা। অংকে পটু মেয়েটার কোনো হিসেবই আর মেলেনা। আর মিলাতেও পারেনি। আত্নহত্যা ছাড়া আর কোনো পথই তার সামনে খোলা ছিলোনা। ডাক্তারকে বলে কয়ে অনেক কষ্টে দুইপাতা পেইজ.5 কিনে নেয়। এরপরে চিরতরে চলে যায়...
ততদিনে বসুন্ধরা থেকে ক্রয়করা জামার বয়স,পাঁচ মাস।
অসময়ে দরজায় অনবরত কড়া নড়ছেই,মনে হচ্ছে বিপদ ঘন্টা। এই সময়ে তো কারো আসার কথা না,তবে কি দুর্দিনের একান্ত সহযোগী পলাশ এসেছে? ওই একমাত্র ব্যক্তি, যে কিনা রাসেলের নতুন ঠিকানা জানে। কিন্তু এই সময়ে তো ওর আসার কথা না। তবে কে? কিছুটা ভয়কে সঙ্গি করে রাসেল ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খোলার পরে দেখে কেউ নেই। তবে কে কড়া নাড়ল? কিছুই ববুঝতে পারেনা। ইদানীং ওর এরকম হচ্ছে,অজানা ভয় ওকে ঘিরে ধরেছে। দরজা বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এখন আর ঘুমের ভিতর ও রঙ্গিন স্বপ্ন দেখেনা, দেখে কে যেন ওকে তাড়া করেছে।সেই অপ্সরীকে আজ ওর পেত্নি মনে হয়। স্মিথ হাসির বদলে ওর কান আজ বিকট শব্দ শোনে, যে শব্দের উৎস খুঁজে পায়না। লাশ দাফনের আগেই রাসেলের নামে ধর্ষণের মামলা হয়।বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ! পত্রিকা গুলো খবর ছাপানোর প্রতিযোগীতায় নামে। নারীবাদীদের প্রতিবাদী শ্লোগানে রুচি ফিরে আসে। সহ-পাঠীরা মানববন্ধন করে,পাঠশালার সামনের রাস্তায়।দাবি একটাই! ধর্ষক রাসেলকে গ্রেফতার করে শাস্তি দিতে হবে। এমন শাস্তি,যাতে কেউ আর এমন না করে। যেদিন রাসেলের নামে থানায় মামলা হলো, সেদিনই ও বাড়ী ছেড়েছে। বন্ধু পলাশই ওকে এই অজপাড়া গায়ে নিয়ে এসেছে। যেই রাসেল প্রেয়সীর স্নিগ্ধ কন্ঠ না শুনলে ঘুমাতে পারতোনা, সেই রাসেল আজ মুঠোফোনই ব্যবহার করেনা। পুলিশ ওকে হন্যে হয়ে খুঁজছে, এ কথা ও ভালো করেই জানে। এইত গতকাল ও বাড়ীতে গিয়ে পুলিশ, পরিবারের অন্যদের শাসিয়ে আসে। বাচ্চাটা আর কিছুদিন পার হলেই দুনিয়ার আলো দেখতে পেতো। আলো দেখতে না পেয়েই ওর জন্য ভালো হয়েছে, ও কার পরিচয়এ বড় হতো? এই সমাজ ওকে মেনে নিতোনা। এসব কথা লোকে বলাবলি করছে। পাশাপাশি দুটি কবরে দুইটা লাশ দাফন হয়ে যায়। আজ কেউ ওদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া করেনা। কেউ ফুলের তোড়াও দিয়ে যায়না। ওদের স্মরণে কেউ মোমবাতিও জালায়না। কারন একটাই! ওরা কলঙ্কিত। ওদের গা থেকে সুবাস ছড়ায়না, তাই কেউ আর গোলাপের পাপড়ি ছিটায়না। পুলিশের ট্রাপে পা দিয়ে অবশেষে রাসেল ধরা পরে। পুলিশের হাতে অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ছবি চলে যায়। ইভিডেন্স হিসেবে লাবনীর শেষ চিঠিও পুলিশের হাতে। যেখানে সব দোষের বোঝা রাসেলের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। মামলায় কোনো সাক্ষী পাওয়া যায়না, কেউ রাসেলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে চায়না। তবুও বিভিন্ন জায়গা থেকে চাপ বাড়তে থাকে কোর্ট এর উপর। অবশেষে চিঠি আর আটমাস বয়সী বাচ্চার ডিএনএ টেস্ট ও জনদাবির মুখে রাসেলের যাবজ্জীবন সাজা হয়ে যায়। সেচ্ছায় অপকর্ম হয়ে যায় ধর্ষণ! এ নিয়ে রব ওঠে সমালোচক মহলে। কিন্তু কিছুই আর করার থাকেনা। আজ রাসেল চাকুরী করে, তবে সেটা কারাগারের মালির পোস্টে। যার কোনো বেতন নেই। ফুলের পরিচর্যা করেই সে জীবনের স্বার্থকতা খুজে বেড়ায়।
লেখক ওমর ফারুক তাওহীদ অধ্যয়নরত, মাস্টার্স


লেখকের আরও ছোট গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন

No comments:

Post a Comment